না,
এমন কোনো ধ্বংসযজ্ঞ চালাননি। আবির্ভাবেই যে কাটার জাদুতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন, তেমন
কোনো জাদুর পরশ বুলিয়ে দেননি। নামের পাশে নেই ৫-৬ উইকেট। তবু এ দিনের মুস্তাফিজ
দুর্দান্ত; প্রতিকূলতার দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসা মুস্তাফিজ।
আগের দিন নিয়েছিলেন একটি উইকেট। সেটিও মুশফিকুর রহিমের দুর্দান্ত ক্যাচের সৌজন্যে।
বুধবার নিয়েছেন আরও দুটি। সব মিলিয়ে ৮৪ রানে ৩ উইকেট। বোলিং ফিগার বলবে, আহামরি
কিছু নয়। বাস্তবতা ছিল ভিন্ন!
তৃতীয় দিনের মুস্তাফিজ ছিলেন
আগ্রাসী। শরীরী ভাষায় ছিল বারুদ। এদিনের মুস্তাফিজ ছিলেন পরিশ্রমী। স্রেফ বোলিং
করার জন্য করা নয়, বরং ছিল কিছু করে দেখানোর তাড়না। মন্থর উইকেটে ওভারপ্রতি চার
রানকেও তাই অনায়াসে চালিয়ে নেওয়া যায়। কারণ প্রায় প্রতিটি বলেই কিছু না কিছু করতে
চেয়েছেন। ব্যাটসম্যানদের ভাবিয়েছেন, ভুগিয়েছেন।
যেটি চোখে পড়ার মত, তিন উইকেটের
একটিও কাটারে নয়। তার ‘ট্রেডমার্ক’
এই ডেলিভারি ছাড়াই করেছেন প্রভাব বিস্তারী বোলিং। লেংথের বৈচিত্র্য ছিল, মেরেছেন বাউন্সার।
ছিল সুইংয়ের প্রচেষ্টা। ডেভিড ওয়ার্নারকে আউট করলেন শর্ট বলে। সিমে পিচ করানো একটু
দেরিতে ভেতরে ঢোকা বলে ফিরিয়েছেন ম্যাথু ওয়েডকে। ছিল রিভার্স সুইংয়ের ছোঁয়া। সবই বলে
দিচ্ছে, কাটারের নির্ভরতা কাটিয়ে মুস্তাফিজ এগিয়ে চলছেন সামনে। অস্ট্রেলিয়ার মত
দলকে এই কঠিন কন্ডিশন ও উইকেটেও তিনি ভোগাতে পারেন কাটার ছাড়াও।
অস্ত্রোপচার থেকে ফেরার পর এদিন
নি:সন্দেহে ছিল তার সেরা দিনগুলির একটি। একেবারে খারাপ করছিলেন না এই টেস্টের
আগেও। কেবল চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিটায় ছিলেন বিবর্ণ। তার আগে শ্রীলঙ্কায় তিন ওয়ানডেতে
ছয় উইকেট নিয়েছেন। শেষ টি-টোয়েন্টিতে চারটি। আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে
স্বাগতিকদের বিপক্ষে ৪ উইকেট, ভালো করেছিলেন নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষেও। ‘মুস্তাফিজ
হারিয়ে গেছেন’ বা ‘আগের মুস্তাফিজ আর নেই’
বলে যে রব উঠেছে চারদিকে, সেটা তাই একরকম অমূলকই। এই টেস্ট আলাদা তবু অন্য দিক থেকে।
সেটি হলো তার গতি। চোটের আগে
নিয়মিতই বোলিং করতেন ১৪০ কিলোমিটারের আশেপাশে গতিতে। তার কাটারও তাই কার্যকর হতো
বেশি। কাঁধের অস্ত্রোপচারের পর মুস্তাফিজের সেই গতিই ফিরে আসছিল না আর। সবচেয়ে
দুর্ভাবনা ছিল সেটিই। ১৩০ কিলোমিটার ছাড়াতে পারছিলেন কদাচিৎ।
এই টেস্টে ১৩৫ কিলোমিটার
ছাড়িয়েছেন নিয়মিতই। ছাড়িয়েছেন ১৩৮ কিলোমিটারও। মন্থর উইকেটে এই গতি মানে একটু
সহায়ক উইকেটে গতি ১৪০ কিলোমিটার ছাড়াতেই পারে। গতিটা ভালো ছিল বলেই শরীরী ভাষার
আগ্রাসন কার্যকর হয়েছে আরও বেশি। দিনশেষে সংবাদ সম্মেলনে নিজেও বললেন, গতিটা
অবশেষে সন্তুষ্টির জায়গায় এসেছে। আরও কিছু কাজ করতে চান লেংথ নিয়ে।
লেংথ যে বেশ ভালো ছিল, সেটি ফুটে
উঠেছে বোলিংয়েই। বলার অপেক্ষা রাখে না, মৌসুম শুরুর আগে বোলিং কোচ কোর্টনি ওয়ালশের
সঙ্গে কয়েক দিন নিবিড়ভাবে কাজ করার সুফল পেতে শুরু করেছেন। ওয়ালশ সে সময় বলেছিলেন,
মুস্তাফিজের গতি আগের জায়গায় আনার চেষ্টা করছেন, দেখিয়ে দিচ্ছেন লেংথ বৈচিত্র্য।
মুস্তাফিজ দিনশেষে জানালেন,
ওয়ালশের সঙ্গে কাজের অর্ধেকটা কেবল দিতে পেরেছেন।
“আমি
অল্প কয়েকদিন অনুশীলন করেছি। এখনো ওইভাবে পুরোটা ম্যাচে করা হয় নাই। ফিফটি-ফিফটি
বলতে পারেন।”
অর্ধেক দেখিয়ে যে বোলিং করেছেন,
সেটিও আভাস দিচ্ছে সম্ভাবনাময় নিকট ভবিষ্যতের। ওয়ালশের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার
৮০-৯০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারলে কী দারুণ ফলই না অপেক্ষা করছে!
আরও দুটি দিক থেকে মুস্তাফিজের
এদিনের বোলিং গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, অস্ট্রেলিয়াকে বার্তা দেওয়া। এই
উইকেট-কন্ডিশনেও দারুণ বোলিং করেছেন প্যাট কামিন্স। বাংলাদেশও যে শুধু স্পিন
সর্বস্ব দল নয়, এই প্রতিকূল আবহেও কার্যকর বোলিংয়ের মত স্কিলফুল পেসার বাংলাদেশের
আছে, সেটি দেখিয়ে দেওয়া।
দ্বিতীয়ত, তার নিজের আত্মবিশ্বাস।
এই উইকেটে অস্ট্রেলিয়ার মত দলের বিপক্ষে কাটার নির্ভর না হয়েও যেভাবে কার্যকর
হয়েছেন, নতুন কিছু স্কিলের নমুনা দেখিয়েছেন, তার আত্মবিশ্বাসের জন্য এটি হবে দারুণ
টনিক। তিনি এখন জানেন, উইকেটে কাটার গ্রিপ না করলে, পেসারদের জন্য কিছু না থাকলেও
সফল হওয়ার মত রসদ তার আছে। এক ধাক্কায় তাকে পরের ধাপে পৌঁছে দিয়েছে এই টেস্টের
বোলিং।
সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত এই টেস্ট
থেকে বাংলাদেশের সেরা প্রাপ্তি তৃতীয় দিনের মুস্তাফিজের বোলিং। ঢাকা টেস্টে প্রথম
স্পেলে দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন। এরপর একটু বিবর্ণ হয়ে যান। সেটি ছিল হয়ত
ট্রেলার। এবার দেখা গেছে সিনেমার আধেকটা, তিনি যেমন বলেছেন, ‘ফিফটি-ফিফটি’।
সামনে পুরোটা দেখার অপেক্ষা!
ম্যাচের গতিপথ যেদিকেই গড়াক,
মুস্তাফিজের গতিপথটা বোঝা গেছে নিশ্চিত। শুধু কাটারের জাদু নয়,
পরিপূর্ণ বাঁহাতি পেসার হয়ে ওঠার পথ।
বাংলাদেশ চাইবে, এই পথ ধরেই এগিয়ে
যাবেন মুস্তাফিজ। এই টেস্টের তৃতীয় দিনটির মতোই!
No comments:
Post a Comment